মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীনতা ও মানবিক মূল্যবোধ রচনা
আসসালামু আলাইকুম প্রিয় পাঠক। আবারো আপনাদের সামনে নতুন একটি রচনা নিয়ে হাজির হলাম। আজকে আমরা মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীনতা ও মানবিক মূল্যবোধ রচনা লেখা শিখবো। সাম্প্রতিক সময়ে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে আবশ্যিক একটি রচনা হলো মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীনতা ও মানবিক মূল্যবোধ।
বিশেষ করে এই রচনার লেখার প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা চলছে। আপনি যদি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় ভালোভাবে এই রচনাটি লিখতে পারেন। তাহলে অবশ্যই বাংলাদেশ শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে পুরস্কার অর্জন করবেন। তাই আজকের আর্টিকেল মনোযোগ সহকারে পড়বেন। চলুন মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীনতা ও মানবিক মূল্যবোধ রচনা লেখা শুরু করি।
Table of Contents
মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীনতা ও মানবিক মূল্যবোধ রচনা
সূচনা
আমাদের দেশের দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ চলে। দীর্ঘ নয়মাস রক্তক্ষয় যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। ২৬ শে মার্চ থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত এই যুদ্ধ চলমান থাকে। তারপর অগণিত শহীদ ও মা বোনদের ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা মূলত ১৬ ডিসেম্বর এর বিজয় অর্জন করি। এ বিজয় ছিল বাংলাদেশের জন্য একটি শ্রেষ্ঠ উপহার। যায় এনে দিয়েছিল আমাদের লাখো মুক্তিযোদ্ধা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস একদিকে যেমন রয়েছে শোকের মতোই মর্মান্তিক, অন্যদিকে ত্যাগের মহিমায় গৌরবময় ও বীরত্বপূর্ণ।
মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পেছনে একটি ঐতিহাসিক পটভূমি রয়েছে। ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন বাংলার শেষ নবাব সিরাজ উদ দৌলা পলাশীর প্রান্তরে এক ষড়যন্ত্রমূলক যুদ্ধে ব্রিটিশদের কাছে পরাজিত হন। সেখান থেকেই নিভতে শুরু করে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য। তখন বাঙালি জাতি ব্রিটিশ দ্বারা প্রায় ২০০ বছর নির্যাতিত হয়। তারা দুইশ বছর রাজত্ব করেছে। বাঙালি জাতি বিদেশি শাসন, অত্যাচার, বঞ্চনা ও নিপীড়নের দায়ে পিষ্ট হয়েছে। স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা আর মনের কোণে লালিত ধূলিকণা- বিভিন্ন সময়ে এদেশের মানুষের মনে জন্ম নেওয়া বিকৃত স্বপ্ন থেকে।
তারপর ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে। এরপর থেকে ভারত উপমহাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষিত হয়। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ব্রিটিশরা ভারতের শাসনভার ত্যাগ করলে হিন্দু ও মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র হিসেবে যথাক্রমে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুইটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রে আবার দুই ভাগ্য বিভক্ত হয় পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান।
দুই অংশের মানুষের মধ্যে কেবল ধর্মে মিল থাকলেও, জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতিতে মিল ছিল না।পাকিস্তানের দুই অংশের জনসংখ্যা প্রায় সমান হওয়া সত্ত্বেও, রাজনৈতিক ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানে কেন্দ্রীভূত হতে থাকে। অর্থাৎ রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সকল ক্ষমতার মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল কর্তৃক পশ্চিম পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তানকে সব সময় নির্যাতন, অত্যাচার ও নির্যাতিত হতে হতো।
তখন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে ধারণা জন্মাতে থাকে যে, অর্থনৈতিকভাবে তাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে ও এরকম বিভিন্ন কারণে তাদের অত্যাচার করতে শুরু করে। ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন দুইটি অঞ্চলের প্রশাসনিক দায়িত্ব নিয়েও মনোমালিন্য দেখা দেয়। এছাড়াও সবথেকে অমিলের বিষয় ছিল রাষ্ট্রভাষা।
পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্না উদ্যোগে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেয়। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে রােধ করার জন্য গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। ১৯৫২ সালে পুনরায় উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘােষণা দিলে ছাত্র সমাজ ও জনতা পুনরায় বিক্ষোভ শুরু করে। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। এ আন্দোলনকে শেষ করার জন্য করার জন্য গুলি চালানাে হয়। এতে শহিদ হন সালাম , রফিক , জব্বার , বরকতসহ অনেকে।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের পরাজয় ও সেই সাথে যুক্তফ্রন্টের অভূতপূর্ব বিজয় লাভ পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর ক্ষমতার ভিতকে নড়বড়ে করে দেয়। যুক্তফ্রন্টের অভাবনীয় বিজয় লাভ পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর ক্ষমতার ভিতকে নড়বড়ে করে দিতে শুরু করে। তারপর আইয়ুব খান ১৯৬৫ সালে মৌলিক গণতন্ত্রের নামে এক প্রহসনের নির্বাচন দিয়ে এদেশের মানুষের রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নেয়। এরপর থেকেই পূর্ব বাংলা মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে।
বাঙালির নিজেদের আদায়ের লক্ষ্যে ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি উত্থাপিত হয় । ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সাজিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে কারাগারে আটক করা হয় । কিন্তু গণআন্দোলনের মুখে তাকে আটকে রাখা সম্ভব হয়ে ওঠেনি । ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাকে ছেড়ে দেয়া হয় ।
১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ জয়ী হলেও,পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তা মেনে নেয় নি। এর ফলস্বরূপ পূর্ব পাকিস্তানে সৃষ্ট আওয়ামী লীগের সন্তুষ্ট জনক বিজয় ও সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ অবদমনে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে মার্চ রাতে নৃশংস গণহত্যা শুরু করে। যা অপারেশন সার্চলাইট নামে অভিহিত।
পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর নির্মম আক্রমণের পর ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। চট্টগ্রামের কালুরঘাটে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘােষণা প্রচার করা হয় । গােটা বাংলাদেশ জুড়ে স্বাধীনতার জন্য স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যুত্থান ঘটে। অধিকাংশ বাঙালি স্বাধীনতার ঘোষণাকে সমর্থন করে ও তাপ নির্দেশ মত যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার ফলে প্রায় এক কোটি মানুষ ভারতের শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।
মানবিক ও অর্থনৈতিক সংকটের মুখে ভারত আমাদের দেশের মুক্তিবাহিনীকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে। এভাবে ২৬ শে মার্চ থেকে বাঙালীরা পশ্চিম সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে শুরু করে।
মুক্তবাহিনী গঠন
স্বাধীনতা সংগ্রামকে বেগবান ও আন্দোলন পূর্ণ করার জন্য মুক্তিবাহিনী গঠন করা হয়। মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি ছিলেন জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী। মূলত তার নেতৃত্বে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালী ১১ টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। প্রতিটি সেক্টরের জন্যে একজন করে অধিনায়ক নির্বাচন করা হয়। এ দেশের অসংখ্য ছাত্র জনতা , পুলিশ , ইপিআর , আনসার ও সামরিক,বেসামরিক, সাধারণ মানুষ ও নারীদের সমন্বয়ে মুক্তিবাহিনী গঠন করা হয়।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত ও দেশকে মুক্তি করার লক্ষ্যে তারা যুদ্ধ কৌশল, অস্ত্রচালনা ও বিস্ফোরক ব্যবহার সম্পর্কে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। যতই দিন যেতে থাকে ততই সুসংগঠিত হতে থাকে মুক্তিবাহিনী। মুক্তিবাহিনী তাদের মেজরদের অনুসারে যুদ্ধ প্রশিক্ষণ শুরু করে। শত্রুদের বিপর্যস্ত করে। বিশাল শত্রুবাহিনী আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়েও মুক্তিবাহিনীর মােকাবিলায় সক্ষম হচ্ছিল। তারপর থেকে শুরু হয় মুক্তিবাহিনীর অসাধ্য সাধন করা। তারা দীর্ঘ নয় মাস চলমান যুদ্ধ করতে শুরু করে।
ভারত ও অন্যান্য দেশের সহযোগিতা
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমাদের অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি দিয়ে সাহায্য করেছিল ভারত। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী অর্থনৈতিকভাবে লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর ভার কাঁধে নেওয়ার চেয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। এছাড়াও কূটনৈতিক সহায়তার মাধ্যমে ভারত আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।
যুদ্ধে পরাজয় বুঝতে পেরে পাকিস্তান এই যুদ্ধকে পাক ভারত যুদ্ধ বলে আখ্যা দিয়ে আন্তর্জাতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করে। ৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান বিমান হামলা করার পর,এদিনই ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেন। তারপর নেপাল,ভুটান ও পার্শ্ববর্তী দেশ গুলো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে।
বিজয় অর্জন
ভারতীয় সেনাবাহিনী ও আমাদের মুক্তিবাহিনীর সম্মিলিত সংগ্রামে ১৬ ডিসেম্বর বিকেল ৪ টা ৩১ মিনিটে ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান নিয়াজী ৯৩ হাজার সৈন্যসহ বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে। পাকিস্তানের পক্ষে লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পণেল দলিলে স্বাক্ষর করেন। যার ফলে দীর্ঘ ৯ মাসের দীর্ঘ সংগ্রামের অবসান ঘটে ও আমরা বিজয় অর্জন করি।স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের জন্য আবেদন করে।
যুদ্ধবন্দিদের স্থানান্তরের প্রক্রিয়া সহজ করতে ভারত ও পাকিস্তান ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে সিমলা চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তি যুদ্ধবন্দিদের ফেরত পাওয়ার বিনিময়ে পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের স্বীকৃতি নিশ্চিত করে। তারপর বিশ্বের মানচিত্রে জন্ম নেয় বাংলাদেশ নামক স্বাধীন সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র।
মুক্তিযুদ্ধের কল্যাণে মানবিক মূল্যবোধ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একজন মানবিক মানুষ ছিলেন। তিনি সেই শৈশবকাল থেকেই মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসতেন। তার মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত ছিল। তার শৈশব কালের সেই মানবতা শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের ময়দানে এসে হাজির হয়। মূলত তার মানবিক মূল্যবোধের কারণে মানুষ যুদ্ধ করার শক্তি ও সাহস পেয়েছিল। এটা থেকে আমাদের অবশ্যই শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। এছাড়াও মূল্যবোধ হল সমাজের আদর্শের মাপকাঠি। যাইতে সমাজ ও দেশকে সুষ্ঠু সুন্দর ও সম্প্রীতি গড়ে তোলে।
উপসংহার
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সাথে মিশে আছে ছাত্র সমাজ, শিক্ষক, কৃষক শ্রমিক, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী তথা আপামর জনতার রক্তিম স্মৃতি। এছাড়াও রয়েছে লাখাে শহিদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের অস্মরণীয় অবদান। তাই শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে হবে। তবেই মুক্তিযুদ্ধের সার্থকতা প্রতিফলিত হবে। মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীনতা ও মানবিক মূল্যবোধ রচনা কেমন লেগেছে তা কমেন্ট করে জানাবেন।